Summary
বস্তুর গতি অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োগিত প্রভাবকে বলা হয় বল। বল প্রয়োগে স্থিতিশীল বস্তু গতিশীল, গতিশীল বস্তু বেগ পরিবর্তিত, অথবা গতিশীল বস্তু স্থিতিশীল হয়। বলের বিভিন্ন রূপ ও প্রয়োগের কৌশল রয়েছে, যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজ সম্পন্ন করতে অথবা কাজকে সহজ করতে সাহায্য করে। বল দ্বারা কার্যকরী কাজকে সহজ করার জন্য কল বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
এই অধ্যায়ে আমরা বল ও সরল যন্ত্রের সম্বন্ধে জানব। অধ্যায়ের শেষে, আমাদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বোঝার ক্ষমতা থাকবে:
- বল ব্যাখ্যা করা
- বিভিন্ন প্রকার বলের প্রভাব বিশ্লেষণ করা
- বিভিন্ন ধরনের সরল যন্ত্রের কাজ ব্যাখ্যা করা
- সরল যন্ত্রের সুবিধা তুলনা করা
- মানব দেহের অঙ্গের সাথে সরল যন্ত্রের কাজের তুলনা করা
- জীবনে বলের প্রভাব ও সরল যন্ত্রের অবদান উপলব্ধি করা
- ব্যবহারিক জীবনে সরল যন্ত্র ব্যবহার করা
কোন বস্তুর গতি অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে যে প্রভাব প্রয়োগ করতে হয় তাকে বলা হয় বল। বল প্রয়োগে স্থিতিশীল বস্তু গতিশীল হয়, গতিশীল বস্তুর বেগ পরিবর্তিত হয়, কিংবা গতিশীল বস্তু স্থিতিশীল হয়। বলের আছে বিভিন্ন রূপ। বল প্রয়োগেরও আছে বিভিন্ন কৌশল। এইসব কৌশলে বল প্রয়োগ করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব, এবং কাজকে সহজ করাও সম্ভব। বলের প্রয়োগ দ্বারা সম্পন্ন কাজকে সহজ করে যেসব কল তাদের বলা হয যন্ত্র। এই অধ্যায়ে তোমরা বল সম্বন্ধে জানবে। সেই সাথে সরল কিছু যন্ত্র সম্বন্ধেও জানবে।
এই অধ্যায় শেষে আমরা
- বল ব্যাখ্যা করতে পারব।
- বস্তুর ওপর বিভিন্ন প্রকার বলের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারব।
- বিভিন্ন ধরনের সরল যন্ত্রের কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব।
- বিভিন্ন প্রকার সরল যন্ত্রের সুবিধা তুলনা করতে পারব।
- মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে সরল যন্ত্রের কাজের তুলনা করতে পারব।
- আমাদের জীবনে বলের প্রভাব এবং সরল যন্ত্রের অবদান উপলব্ধি করব।
- ব্যবহারিক জীবনে সরল যন্ত্রের ব্যবহার করতে পারব।
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
একটি স্থির মার্বেলকে লক্ষ করে অপর একটি মার্বেলকে ছুড়ে মারা 'হলো। এ মার্বেলটি স্থির মার্বেলকে ছিটকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল।
তোমরা কি জান বে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জানা বা অজানা বিভিন্নভাবে আমরা বল প্রয়োগ করে থাকি। তোমরা ভাবছ এই বলটা আবার কী? সকাল থেকেই শুরু হয় আমাদের নানাভাবে বিভিন্ন বস্তুর ওপর বলের প্রয়োগ। ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোয়ার জন্য পানির কল ছাড়তে বা টিউবওয়েলে চাপ দিতে আমাদের বল প্রয়োগ করতে হয়। এমনকি পড়তে বসার সময় চেয়ারকে টেনে বসতেও বল প্রয়োগ করতে হয়। আবার ধর, তোমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে তোমার জ্যামিতি বক্সটি আছে। এটিকে বের করতে এবং বের করার পর পুনরায় ড্রয়ারটিকে বন্ধ করতে ড্রয়ারটিকে যথাক্রমে টান বা ধাক্কা দিতে হয়। তুমি নিশ্চয়ই তোমার ঘরের বাতিটি জ্বালানোর জন্য সুইচটি অন করেছ। এটিতেও কিন্তু বলের প্রয়োগ হয়েছে। কাউকে কি কোকের ক্যান খুলতে দেখেছ। এটিও কিন্তু বল প্রয়োগ। ফুটবলে লাথি দেওয়া বা ক্রিকেট বলে ব্যাট দিয়ে আঘাত ও বল। উপরোক্ত ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে দুটি জিনিস জড়িত- ধাক্কা বা টান। এই ধাক্কা বা টানই হলো বল।

বস্তুর ওপর বলের বিভিন্ন প্রভাব
তোমার তো নিশ্চয়ই একটি রাবার আছে। তুমি কি কখনও দেখেছ একে বাঁকালে, মোড়ালে, চেপে ধরলে বা টানলে এর আকৃতির কিরূপ পরিবর্তন হয়। এই বাঁকানো, মোচড়ানো, চাপা, লম্বা করার চেষ্টাও হলো একই বস্তুর ওপর বল প্রয়োগের বিভিন্ন পদ্ধতি। এগুলোর কি চিত্র অঙ্কন করতে পারবে?
আরেকটি মজার ঘটনা লক্ষ্য কর। মার্বেল দিয়ে কি কখনো খেলেছ? প্রথমে মার্বেলগুলো সামনে ছড়িয়ে রাখতে হয়। পরে একটু দূর থেকে অন্য একটি মার্বেল দ্বারা ছড়ানো মার্বেলগুলোর মধ্যে কোনো একটিকে আঘাত করার জন্য লক্ষ্য স্থির করতে হয়। যখন তুমি তোমার হাতের মার্বেলটি ছুড়বে তখন এটি তোমার লক্ষ্যের মার্বেলটিকে আঘাত করলে তুমি কী দেখতে পাবে? দেখবে মার্বেলটি আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার পর স্থির অবস্থা থেকে গতিশীল হয়েছে। হয়ত দেখবে এটি আবার অন্য কোনো স্থির মার্বেলকে আঘাত করেছে। অথবা মোট একই গতিতে চলমান রয়েছে। গতিপ্রাপ্ত মার্বেলটির ওপর কোনো বল প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এই গতি চলতে থাকবে। অন্য কোনো বল না থাকলেও মাটির ঘর্ষণ বলই এক সময় মার্বেলটিকে থামিয়ে দেয়।

আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কোনো একটা মাইক্রোবাস হয়ত রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ল। তখন হয়তো একে পুনরায় চালু করার জন্য ধাক্কা দেওয়া প্রয়োজন। তখন একজন হয়তো একে ধাক্কা দিলে এটি নাও নড়তে পারে। কিন্তু ৪/৫ জন একসাথে ধাক্কা দিলে এটি নড়তে পারে এমনকি চলতেও পারে। এখানে বল প্রয়োগের ফলে স্থির বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে বা ঘটতে চায়।
এখন বলতে পারবে এখানে কী কী ঘটনা ঘটেছে। বলের প্রভাবে মার্বেলের গতির বিভিন্ন পরিবর্তন হলো। একইভাবে সাধারণত বল প্রয়োগে স্থির বস্তুকে গতিশীল করা যায়, গতিশীল বস্তুর গতি বাড়ানো বা কমানো যায় এবং গতিশীল বস্তুকে থামানো যায়। উপরের উদাহরণগুলো থেকে আমরা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
বল প্রয়োগের ফলে-
- কোনো স্থির বস্তু গতিশীল এবং গতিশীল বস্তু স্থির হয় বা হতে চায়।
- চলন্ত বস্তুর গতি বাড়তে বা কমতে পারে।
- চলন্ত বস্তুর গতির দিক পরিবর্তন হয়।
- কোনো বস্তুর আকার বা আকৃতি পরিবর্তন হয়।
অনুরূপভাবে বলা যায়, যা কোনো স্থির বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে তাকে গতিশীল করে বা করতে চায় অথবা যা কোনো গতিশীল বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে তার গতি, আকার ও আকৃতি পরিবর্তন করে বা করতে চায় তাই বল।
বৈদ্যুতিক সুইচ 'অফ' বা 'অন' করা, কোকের ক্যানের মুখ খোলা, মসলা পেষা, বোঝা তোলা, ঢিল ছুঁড়ে মারা, নৌকা বাওয়া, চলাফেরা করা, কম্পিউটারের মাউসে ক্লিক করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বলের ব্যবহার দেখা যায়। এমনকি মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে ঠেলাগাড়ি, রিকশা প্যাডেল সবকিছুতেই বলের প্রয়োগ দেখা যায়।
এক খণ্ড পাথর বা ইটের উপর ঠেস দিয়ে লম্বা লোহা অথবা কাঠের দণ্ডের এক প্রান্তে বল প্রয়োগ করে অন্য প্রান্ত দিয়ে ভারি কোনো বস্তুকে উপরে তুলতে বা সরাতে দেখেছ নিশ্চয়? হ্যাঁ লোহা বা কাঠের দণ্ডটিকে বিশেষ এই ব্যবস্থায় ব্যবহার করার ফলে ভারি কোনো বস্তুকে সরানোর কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যেতে পারে। তোমার শ্রেণিকক্ষে এই ধরনের কাজ সহজেই করে দেখতে পার। এ ক্ষেত্রে লোহা বা কাঠের দণ্ডের এভাবে ঠেস দিয়ে কাজ করার মাধ্যমে এটি একটি সরল যন্ত্র হিসাবে↓ কাজ করেছে। এর মাধ্যমে একটি বিশেষ কৌশলে প্রয়োগকৃত বল দ্বারা সহজেই কাজটা করা সম্ভব হয়েছে। মূলকথা, কম বল প্রয়োগেও অধিক কাজ করা সম্ভব হয়েছে।

কাজকে এভাবেই সহজ করার জন্য দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানাবিধ সরলযন্ত্র ব্যবহার করে থাকি। যেমন: কাঁচি, সাঁড়াশি, হাতুড়ি, শাবল, কপিকল, লিভার ইত্যাদি। এই যন্ত্রগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোর মধ্যে বিশেষ কোনো কৌশল প্রয়োগ করে কাজকে সহজ করা যায়। উপরে উল্লিখিত সরল যন্ত্র নিম্নোক্ত এক বা একাধিকভাবে কাজকে সহজ করে।
- প্রযুক্ত বলকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে।
- কম বল প্রয়োগে কোনো কাজ সম্পন্ন করে।
- বলকে কোনো একটি সুবিধাজনক দিকে প্রয়োগ করে।
- কাজকে নির্দিষ্ট একটি উপায়ে সম্পন্ন করে যা অন্য কোনো উপায়ে করা কঠিন।
- গতি ও দূরত্ব বৃদ্ধি করে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, সকল যন্ত্রেই কাজ করতে বাইরে থেকে শক্তির প্রয়োজন হয়। এখন তোমরা আরও কিছু সরল যন্ত্রের সাথে পৃথক পৃথকভাবে পরিচিত হবে এবং এদের থেকে কীভাবে যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় তা ব্যাখ্যা করা শিখবে।
লিভার হলো একটি সরল যন্ত্র, যাতে একটি শক্ত দণ্ড কোনো অবলম্বনের কোনো কিছুর উপর ভর করে মুক্তভাবে ওঠানামা করে বা ঘোরে, পাঠ ৩ এ বর্ণিত ঘটনার দন্ড এবং পাথর বা ইটের ব্যবস্থায় যেমন হয়। লিভারের ব্যবহারের আরেকটি সাধারণ উদাহরণ হলো শাবলকে ইট বা পাথরের উপরে ভর করে কোনো ভারি বস্তুকে উঠাতে সাহায্য করা। এখানে ভারি বস্তুটি হলো ভার এবং এই ভারকে উঠাতে যে বল প্রয়োগ করা হয় তা হলো প্রযুক্ত বল। শক্ত দণ্ডটি কোনো অবলম্বনের যে বিন্দুতে ঠেকানো অবস্থায় মুক্তভাবে ওঠানামা করে বা ঘোরে তা হলো ফালক্রাম। লিভার কোনো ভারি বস্তুকে কম বল প্রয়োগ করে উঠাতে বা সরাতে সাহায্য করে।
এখানে যান্ত্রিক সুবিধা হলো- যান্ত্রিক সুবিধা = ভার / প্রযুক্ত বল
এখন তোমাকে বুঝতে হবে কীভাবে লিভার ব্যবহার করে যান্ত্রিক সুবিধা আদায় করা যায়। লিভারের নীতিমালা হলো নিম্নরূপ:
বল × বলবাহুর দৈর্ঘ্য = ভার ভারবাহুর দৈর্ঘ্য
এখানে বল যে বিন্দুতে প্রযুক্ত হয় তা থেকে ফালক্রাম পর্যন্ত দূরত্ব হলো বলবাহুর দৈর্ঘ্য। অনুরূপভাবে ভার থেকে ফালক্রাম পর্যন্ত দূরত্ব হলো ভারবাহু। তাহলে উপরের নীতিমালা থেকে নিম্নোক্তভাবেও বোঝা যায়।
ভার / বল = বলবাহুর দৈর্ঘ্য / ভারবাহুর দৈর্ঘ্য
এখানে নির্দিষ্ট বল দ্বারা কীভাবে নির্দিষ্ট ভরের বস্তুকে উঠানো বা সরানোর ক্ষেত্রে যান্ত্রিক সুবিধা আদায় করব তা একটি কাজের মাধ্যমে দেখব।
| কাজ: একটি পেনসিলকে রুলারের সাথে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে একটি লিভার তৈরি কর। এখানে পেনসিলটি ফালক্রাম হিসেবে কাজ করবে। এবার প্রথমেই রুলারটিকে সামনে-পিছনে সরিয়ে ভূমির সমান্তরাল কর। এবার দুই পাশে পাঁচটি করে ৫ টাকার মুদ্রা এমনভাবে রাখ যেন পুনরায় রুলারটি ভূমির সমান্তরাল হয়। এবার ডান দিকে পুনরায় আরও ৫টি মুদ্রা রাখ। কী হবে! নিশ্চয়ই ডান দিকটি ঝুঁকে পড়েছে? এবার পুনরায় রুলারটি সামনে পিছনে করে বাম প্রান্তে ৫টি এবং ডান প্রান্তে ১০টি মুদ্রা রেখে ভূমির সমান্তরাল কর। এতে কী হলো? ভারবাহুর দৈর্ঘ্য কমে গেল এবং বলবাহুর দৈর্ঘ্য বেড়ে গেল। একে আমরা বলতে পারি যান্ত্রিক সুবিধা আদায় হলো। অর্থাৎ কম বল প্রয়োগ করে বেশি ভার তোলা হয়েছে। পুনরায় আরও ৫টি পয়সা দিয়ে দেখ কী হয়। |
প্রযুক্ত বল, ভার ও ফালক্রামের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে লিভারকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-
প্রথম শ্রেণির লিভার: এই ক্ষেত্রে ফালক্রামের অবস্থান প্রযুক্ত বল ও ভারের মাঝখানে থাকে। যেমন: কাঁচি, সাঁড়াশি, নিক্তি, নলকূপের হাতল, পানি সেচের দোন, ঢেঁকি ইত্যাদি।
দ্বিতীয় শ্রেণির লিভার: এই ক্ষেত্রে ভার থাকে মাঝখানে এবং প্রযুক্ত বল ও ফালক্রাম দুই প্রান্তে অবস্থান করে। যেমন: যাঁতি, এক চাকার ঠেলা গাড়ি, বোতল খোলার যন্ত্র ইত্যাদি।
তৃতীয় শ্রেণির লিভার: এই ক্ষেত্রে প্রযুক্ত বলটি মাঝখানে কার্যকর হয়। ভার ও ফালক্রাম থাকে দুই প্রান্তে। যেমন: চিমটা।
এখন এই কাঁচি, যাঁতি বা চিমটা ব্যবহার করে কীভাবে কাজকে সহজে করা যায় তা দেখব।
প্রথমত: কাঁচি দিয়ে কিছু কাটার সময় উক্ত বস্তু (যেমন কাপড়) যত বেশি ফালক্রামের কাছে রেখে কাটা যাবে ততই কাটা সহজ হবে। মূলত এক্ষেত্রে ভার বাহুর দৈর্ঘ্যকে কমানোর চেষ্টা করে যান্ত্রিক সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়।

দ্বিতীয়ত: যাঁতির ক্ষেত্রে ভর (যেমন সুপারি) কে যত বেশি ফালক্রামের কাছে রাখা যাবে, সুপারি কাটতে তত কম বল প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রেও ভারবাহুর দৈর্ঘ্য কমিয়ে বা বলবাহুর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায়।

তৃতীয়ত: একটি চিমটা দিয়ে কিছু আটকানোর ক্ষেত্রে আঙ্গুলের চাপটি যত বেশি বস্তুর কাছাকাছি হবে বস্তুটিকে আটকে রাখা তত বেশি সহজ হবে। এখানেও মূলত বলবাহুর দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে বা ভারবাহুর দৈর্ঘ্য কমিয়ে কাজ সহজ করা হয়।

একটি হাতুড়ির সাধারণত দুই প্রান্ত থাকে। এক প্রান্ত দিয়ে কাঠে লোহা ঢুকানো হয় এবং অন্য প্রান্ত দিয়ে কাঠ থেকে লোহা বের করা হয়। হাতুড়ি দিয়ে যখন লোহা বের করা হয় তখন হাত দিয়ে হাতুড়িটির হাতল ধরে বল প্রয়োগ করা হয়। আবার যেখানে লোহাটি থাকে তার পাশে ঠেস দিয়ে এটি উঠানো হয় যেটি ফালক্রাম হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে লোহা বের করার বাধা ভার হিসেবে কাজ করে। এখানে ফালক্রামটি মাঝখানে কাজ করে বিধায় এটি প্রথম শ্রেণির লিভারের মতো কাজ করে।

সাঁড়াশি
এটিও লিভার হিসেবে কাজ করে। সাঁড়াশির যেখানে হাত দিয়ে ধরা হয় সে প্রান্তটিতে বল এবং যে প্রান্তটিতে কোনো বস্তুকে ধরে রাখা যায় সে প্রান্তটিতে ভার কাজ করে। এখানে ফালক্রামটি মধ্যে থাকে বলে এটি প্রথম শ্রেণির লিভারের অন্তর্ভুক্ত। এটিতে ভারবাহুর দৈর্ঘ্য অপরিবর্তনীয়, তাই কেবলমাত্র বলবাহুর দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে এর যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায়।

হেলানো তল
হেলানো তল হলো একটি সরল যন্ত্র। এর সাহায্যে একটি ভারি বস্তুকে খাড়াভাবে তোলার চেয়ে এটাকে গড়িয়ে ওপরে তোলা যায়। হেলানো তলের ব্যবহারে কাজ অনেক সহজ হয় বলেই উঁচু পুলে ওঠার রাস্তা, দালানের ছাদে উঠার সিঁড়ি ইত্যাদি খাড়াভাবে তৈরি না করে হেলানোভাবে তৈরি করা হয়। হেলানো তলের উপর দিয়ে বস্তুকে গড়িয়ে তুলতে দূরত্ব বেশি অতিক্রম করতে হয় কিন্তু বল প্রয়োগ করতে হয় কম। এটা বোঝার জন্য এর যান্ত্রিক সুবিধা বুঝতে হবে। হেলানো তলের যান্ত্রিক সুবিধা হলো
যান্ত্রিক সুবিধা = ভার / বল = হেলানো তলের দৈর্ঘ্য / হেলানো তলের উচ্চতা
এখান থেকে বুঝা যায় একই উচ্চতায় উঠানোর জন্য হেলানো তলের দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে যান্ত্রিক সুবিধাও তত বেশি হবে।
তোমরা কি কেউ দেখেছ কীভাবে একটি গাড়ির চাকা পরিবর্তন করা হয়? একটি সরলযন্ত্রের বা জ্যাক স্ক্রু এর সাহায্যে প্রথমে গাড়িটির একপ্রান্ত উঁচু করা হয় যাতে সহজেই চাকা খুলে আবার লাগানো যায়। জ্যাক ক্রু একসাথে লিভার ও হেলানো তলের নীতি মেনে কাজ করে। ক্রুর পেঁচানো অংশের উচ্চতা হলো হেলানো তলের উচ্চতা এবং পেঁচানো পথ দিয়ে ঘুরে যেতে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে তা হলো হেলানো তলের দৈর্ঘ্য। এই যন্ত্রে হেলানো তলের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায়। অপর দিকে হাতলে যেদিকে বল প্রয়োগ করা হয় ভার কাজ করে তার লম্ব বরাবর। ফলে জ্যাক স্ক্রু একই সাথে বল বৃদ্ধি ও বলের দিক পরিবর্তন করে কাজকে সহজ করে।

কপিকল
কপিকল হলো এক ধরনের সরল যন্ত্র। এতে একটি খাঁজ কাটা চাকতি থাকে যাতে একটি রশি দুই দিকে ঝুলিয়ে দেয়া ও যায়। কপিকলটি একটি অক্ষদণ্ডকে কেন্দ্র করে ঘোরে যা একটি স্থির ব্লকের সাথে সংযুক্ত থাকে। কপিকল সাধারণত কোনো ভারি বস্তু উপরে উঠাতে বা কুয়া থেকে পানি উঠাতে ব্যবহৃত হয়। কপিকল অনড় বা নড়নক্ষম হতে পারে। অনড় কপিকলে ব্লকটি স্থির থাকে, কেবলমাত্র চাকাটি ঘোরে। অন্যদিকে নড়নক্ষম কপিকলে ব্লকটি স্থির নয় বরং কপিকলের সাথে এটিও ঘুরতে থাকে।

আমরা পতাকা উপরে উঠানোর জন্য অনড় কপিকল ব্যবহার করে থাকি। এক্ষেত্রে রশি টানার সাথে শুধু মাত্র চাকাটি ঘোরে। এখানে পতাকাকে যত উপরে উঠাবার প্রয়োজন হয় রশিকে তত নিচের দিকে টানতে হয়। ফলে এর মাধ্যমে যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় না। তবে বলের দিক পরিবর্তন করা হয়।

চাকা- অক্ষদণ্ড এক ধরনের সরলযন্ত্র। এটা মূলত লিভারেরই ভিন্নরূপ। এখানে ভারকে একটি রশির মাথায় বাঁধা হয় এবং চাকাটিকে ঘুরিয়ে সে রশিটি অক্ষদণ্ডে জড়ানো হয়। চাকা ও অক্ষদণ্ডের ব্যাসার্ধের অনুপাতের ওপর এর যান্ত্রিক সুবিধা নির্ভর করে। অর্থাৎ যদি চাকার ব্যাসার্ধ অক্ষদণ্ডের ব্যাসার্ধের ৬ গুণ হয় তবে ১ কিলোগ্রাম বল প্রয়োগ করে ৬ কিলোগ্রাম ভরের বস্তুকে উপরে উঠানো যাবে। তাহলে একটি ব্যাপার স্পষ্ট যে, চাকা অক্ষদণ্ডের যান্ত্রিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এর চাকার ব্যাসার্ধ বেশি হওয়া প্রয়োজন। মোটরগাড়ির হুইল, স্ক্রু-ড্রাইভার ইত্যাদি চাকা- অক্ষদণ্ডের মতো কাজ করে।

কাজ: ক্রু ড্রাইভারের যান্ত্রিক সুবিধা নির্ণয়। ![]() |
মানবদেহ একটি জটিল যন্ত্র। এর কোনো কোনো অঙ্গ সরলযন্ত্রের মতো কাজ করে থাকে। মূলত আমাদের শরীরের বেশ কিছু অঙ্গ লিভারের নীতি অনুসরণ করে কাজ করে থাকে। নিচে এমন তিনটি অঙ্গের সাথে পরিচিত হবে।
নিচের চিত্রগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কীভাবে মানুষের মুখের চোয়াল, পায়ের নিচের অংশ ও হাত সরল যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। এবার চিন্তা কর কীভাবে এই অঙ্গগুলো ব্যবহার করে কাজ করলে কোনো কাজকে সহজে করা যাবে। তুমি কি এখন বলতে পারবে আমরা খাবার চিবানোর সময় সামনের দাঁত দিয়ে না চিবিয়ে কেন মাড়ির দাঁত দিয়ে চিবাই?

| কাজ: একটি পাথর (১ কেজির মতো) তোমার আঙ্গুলের ডগা থেকে কুনই পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় রেখে অনুভব কর কেমন লাগছে। এর থেকে বুঝা যাবে হাতকে কীভাবে ব্যবহার করলে যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যাবে। |
নতুন শব্দ: স্থির বস্তু, গতিশীল বস্তু, যান্ত্রিক সুবিধা, ফালক্রাম, চাকা, অক্ষদণ্ড ও কপিকল।
এই অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম
- বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর অবস্থান, আকার, আকৃতি বা গতির পরিবর্তন হয় বা হতে পারে।
- সব সরল যন্ত্রেই কোনো একটি বিশেষ উপায়ে একটি কৌশল প্রয়োগ করা যায় যার দ্বারা ঐ যন্ত্র থেকে যান্ত্রিক সুবিধা আদায় করা যায়।
- লিভারের ক্ষেত্রে বলবাহু বা ভারবাহুর দৈর্ঘ্য কমিয়ে বা বাড়িয়ে যান্ত্রিক সুবিধা আদায় করা যায়।
- কোনো বস্তুকে হেলানো তল বরাবর একই উচ্চতায় উঠানোর জন্য যে কোনো তলের দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে যান্ত্রিক সুবিধাও তত বেশি হবে।
- মানবদেহের বেশ কিছু অঙ্গ লিভারের নীতি অনুসারে কাজ করে থাকে।
Read more
